‘The teacher is a maker of man’
শিক্ষক শব্দটি শুনলেই যেন ৯-১২ আউন্সের হৃৎপিণ্ডের ভিতর থেকে এক তীব্র ভালবাসা , আবেগ ও সম্মান চলে আসে। পরক্ষনেই সম্মানে মাথা নত করি আমরা। কেননা শিক্ষক হলেন জাতির আলোকবর্তিকাবাহী এবং মানব জাতির ভবিষ্যতের রূপকার। তিনি আমাদের বন্ধু, দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শক। শুধু পুঁথিগত বিদ্যাই নয়, শিক্ষকদের থেকে যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা আমরা অর্জন করি, তা জীবনের বাকি দিনগুলোতে বহন করে থাকি আমরা।
এ. পি. জে. আবদুল কালাম বলেছিলেন " তিনজন মানুষই পারেন সমাজ,দেশ তথা জাতির পরিবর্তন ঘটাতে । তারা হলেন পিতা, মাতা ও শিক্ষক।" সত্যিকার অর্থেই একটি জাতির কারিগর একজন শিক্ষক । গত ০৫ অক্টোবর পালিত হয়ে গেল বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৯৪ সাল থেকে জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কোর উদ্যোগে প্রতিবছর এ দিবসটি উদযাপিত হয়। এ বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলায় শিক্ষকসমাজ’।
সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষকতা পেশাটি হতে চলেছে আরও বেশী চ্যালেঞ্জিং । পেশার দর্শনদারীতত্ত্বের দিক থেকে মানুষ গড়ার কারিগর অথবা দ্বিতীয় জন্মদাতা শিক্ষকের দর্শনদারীতত্ত্ব ও গুনের কথা বলেছেন বাট্রান ও রাসেল। তাদের মতে, শিক্ষকের কাজ দুটি তা হল শিক্ষার্থীদের পাঠের প্রতি আগ্রহী করে তোলা এবং সেই আগ্রহ নিবৃত করা। বাস্তবিক অর্থে এটি শুনতে যতটা সহজ মনে হয় প্রয়োগ ক্ষেত্র তাই ততটাই কঠিন। আর যারা এই কঠিন কাজটি করতে পেরেছেন সহজেই তারাই হয়ে উঠেন প্রিয় শিক্ষক।
তাদের পরেই মাথানত করে তার শিক্ষার্থীরা। আর যার প্রভাব রয়ে যায় অনন্ত কাল ধরে , তাই হেনরি এডামস বলেছিলেন, ”একজন শিক্ষক সামগ্রিকভাবে প্রভাব ফেলে, কেউ বলতে পারে না তার প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হয়। ” তাই হয়তবা আবহমান কাল ধরে শিক্ষক সমাজে আজও সম্মানের যে জায়গায় অবস্থান করেন, সেটি টাকা ,আয় কিংবা অর্থ বৃত্তে পরিমাপ যোগ্য নয়। যেমনটি মায়ের ভালবাসার কোন অর্থ মূল্য পরিমাপণ করা সম্ভব নয় । তাই শিক্ষকতাকে একটি পেশা বলার থেকে বলা যেতে পারে একটি মহান ব্রত।
যারা বরাবরই এক অনুপ্রেরনার অন্য নাম । কারন ”মাঝারি মানের শিক্ষক বলেন, ভাল শিক্ষক বুঝিয়ে দেন, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক করে দেখান। মহান শিক্ষক অনুপ্রাণিত করেন। ” – উইলয়াম আর্থার ওয়ার্ড
এত গেল পেশা হিসেবে শিক্ষকতার কথা কিন্তু সবার মনে প্রশ্ন আসতে পারে এত এত দিবসের ভিড়ে কেন একটি দিনকে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। শিক্ষকতা সম্মানীয় ব্রত তাই কি? নাকি এই দিবসের পিছনেও রয়েছে কোন প্রিয় শিক্ষকের গল্প।
সালটা ১৯৬২ ভারতীয় উপমহাদেশে তখনও পালন করা হয় না শিক্ষক দিবস। এক প্রিয় শিক্ষকের জন্ম দিন পালন করতে চাইলেন কিছু ছাত্র , শিক্ষক বললেন, “৫ই সেপ্টেম্বর আমার জন্ম দিবস পালন না করে শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করলে আমি অধিক সম্মানিত বোধ করব।” সেই শিক্ষকটি আর কেউ নন ভারতের প্রথম ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ। তার পরেই ১৯৬২ সাল থেকে ভারতে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয়।
ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ ১৯৫২ সাল ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ভারতের উপ রাষ্ট্রপতি এবং ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর পূর্বে তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী এবং লেখক। বিংশ শতাব্দীতে তিনি দর্শন তত্ত্বের একজন মস্ত বড় পন্ডিত ছিলেন। দূর সম্পর্কের এক দাদার কাছ থেকে দর্শনের বই পেয়ে ঠিক করেন তিনি দর্শন নিয়ে পড়া শুরু করেন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার জন্য তিনি “বেদান্ত দর্শনের বিমুর্ত পূর্বকল্পনা ” (The Ethics of the Vedanta and its metaphysical Presuppositions) বিষয়ে একটি গবেষণা মূলক প্রবন্ধ লেখেন।
তিনি ভেবেছিলেন তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধ দর্শনের অধ্যাপক বাতিল করে দেবেন। কিন্তু অধ্যাপক অ্যালফ্রেড জর্জ হগ তার প্রবন্ধ পড়ে খুবই খুশি হন। এই প্রবন্ধ যখন ছাপানো হয় তখন রাধাকৃষ্ণাণ এর বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর।
এরপর অধ্যাপনা করেছেন দেশের ও বিদেশের খ্যাতনামা সব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ।১৯০৯ সালে শুরু করেছিলেন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিযচিলেন হয়ে। এরপর তিনি University of Mysore, University of Calcutta, University of Oxford, University of Chicago ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ করেন। সেই সময় তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি University of Oxford এ অধ্যাপনা করেছিলেন। তার পাশাপাশি তিনি হোমস্কুলিং এবং পাশ্চাত্য মতাদর্শের চিন্তার মধ্যে ব্যবধানকে কমিয়ে দিয়েছিলেন তার গবেষণার মধ্যদিয়ে।
যার ফলস্ফুতিতে তিনি সম্মানিত হয়েছেন বিভিন্ন সম্মানিত পুরস্কারে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পুরষ্কার গুলো হচ্ছে ১৯৫৪ সালে, ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ভারতরত্ন ,তিনি ১৯৬৩ সালে ব্রিটিশ রয়্যাল অর্ডার অফ মেরিটের সম্মানিত সদস্যও ছিলেন। এছাড়াও তিনি নোবেল পুরষ্কারের জন্য .২৭ বার মনোনীত হয়েছিলেন।
তবে ভারতে, ৫ ই সেপ্টেম্বর ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ এর জন্মদিন ও শিক্ষক দিবস হিসাবে স্বীকৃত। এছাড়াও ১৯৯৫ সালের পূর্বে বিশ্বব্যাপী ভিন্ন ভিন্ন তারিখে শিক্ষক দিবস পালন করা হত। এর মধ্যে ব্রাজিলে ১৫ ই অক্টোবর ; অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি অক্টোবরের শেষ শুক্রবার।
অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি অক্টোবরের শেষ শুক্রবার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, জাতীয় শিক্ষক দিবসটি মে মাসের প্রথম সপ্তাহের প্রথম মঙ্গলবার পালন করা হত। কানাডা, বাংলাদেশ, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, নাইজেরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ইত্যাদি দেশগুলি ৫ ই অক্টোবরকে শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করত।
পরবর্তীতে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ সভায় ৫ অক্টোবর দিনটিকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবার দিবসটি পালন করা হয়। তবে ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিভিন্ন দেশে শিক্ষকরা মোটা দাগে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ উদযাপন শুরু করেন। ইউনেস্কোর অনুমোদনে প্রতিবছর পৃথক প্রতিপাদ্যে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
এবারের প্রতিপাদ্য ছিল, “Teachers : Leading in crisis reimagining the future.”। শিক্ষকরা যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করতে পারে তা নিশ্চিত করাই ছিল এ বছরের মুল প্রতিপাদ্য ।
শিক্ষকতা নিঃসন্দেহে একটি মহান পেশা। একজন শিক্ষক সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের কাছে অত্যন্ত মর্যাদা ও সম্মানের পাত্র। ভালো শিক্ষকের সংখ্যায় বেশি তবুও যারা বিপথে এই পেশাকে বেছে নিয়েছে তাদের উচিত জাতি ও দেশ গঠনের লক্ষ্যে সকল অবৈধ সুযোগ সুবিধা ভোগের উদ্দেশ্যে চাটুকারিতা, সমালোচনা, স্বজনপ্রীতি ও স্বার্থপরতা পরিহার করে একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়া। যার প্রধান লক্ষ্য হবে মানবতার কল্যাণ এবং জ্ঞান বিতরণ।
তাহলেই এই মহান পেশার মর্যাদা রক্ষা এবং জাতির কল্যাণ বয়ে আনবে। সেই সাথে বারাক ওবামা বলেছিলেন .”যদি তুমি জীবনে সাফল্য অর্জন করে থাকো তাহলে মনেরাখবে তোমার পাশে একজন শিক্ষক ছিলো যে তোমাকে সাহায্য করেছিলো।“ তাই শিক্ষদের এই ঋনের কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না । শুধু সম্মান নয় পেশার যায়গাটিতেও তাঁদের যথাযথ সম্মান নিশ্চিত করবার দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্রের তার পাশাপাশি আমাদের সকলের । শুধু একটি দিবসে নয় শিক্ষকের পদতলে ভালবাসা ও সম্মানের পুষ্পাঞ্জলি পড়ুক প্রতিটি দিনে।