বিশ্বের ক্ষমতাধর ব্যক্তির তালিকায় থাকা একজন ব্যক্তি যদি তার নাম গোপন করেন তাহলে নিশ্চয়ই অবাক না হয়ে উপায় নেই কিন্তু অবাক হওয়ার আগে একবার কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া একটি এতিম ছেলের কথা চিন্তা করুন হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন আমি হ্যারি পটার সিরিজের কথা বলছিলাম যার সৃষ্টিকর্তা জে কে রাউলিং যেটি ছিল তার ছদ্মনাম।তার পুরো নাম জোয়ান জো রাউলিং। তবে জোয়ান জো রাউলিং থেকে জে. কে রাওলিং হওয়ার গল্পটা কোন ভাবেই সুখকর ছিল না। দিনটি ছিল ১৯৬৫ সালের ৩১ জুলাই ইংল্যান্ডের গ্লুসেস্টারশায়ারের ইয়েটে শহরে ইন্জিনিয়ার বাবা পিটার এবং মা অ্যানির ঘর আলো করে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান যদিও সেদিন কেউই ভাবে নি এই সন্তানই একদিন হয়ে উঠবে একজন সফলতম কল্পকাহিনী লেখিকা।
যদিও তাঁর ঔপন্যাসিক হয়ে উঠার পিছনে কিছুটা কৃতিত্ব ছিল তার ছোট বোনের কেননা ছোট বোনকে গল্প শুনাতে শুনাতেই তার প্রথম হাতে খড়ি হয়। বাবা ও মা দুজনেই কর্মব্যস্ত মানুষ হওয়ায় রাউলিং ও তার ছোট বোনের জন্য প্রচুর গল্পের বই কিনতেন আর সেখান থেকেই রাউলিংয়ের লেখক হয়ে উঠার স্বপ্ন মনের এক কোনে বাসা বাধতে থাকে আর সে স্বপ্ন কে পুরন করতেই রাউলিং ছয় বছর বয়স থেকেই তার বোনের জন্য গল্প লিখতেন ও তা তাকে শুনাতেন।এবং স্বপ্ন দেখতেন তার লেখা বই দোকানে আসা মাত্র পাঠকরা লুফে নিবে। এক সময় তার সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছে।
অত্যন্ত দারিদ্র ও গ্রামীন পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই লেখিকার জীবনজুড়ে কেবল একটিই স্বপ্ন ছিল, এবং সবসময় কেবল একটি কাজই করতে চেয়েছিলেন- সেটি হচ্ছে উপন্যাস লেখা। যথারীতি তাঁর বাবা-মায়ের এই ব্যাপারে কোন সমর্থন ছিল না! কেননা তারা দুজনেই উঠে এসেছিলেন অসচ্ছল পরিবার থেকে, কলেজ পর্যন্ত পড়ালেখাও করেননি দুজনের কেউ। তাদের কাছে এই স্বপ্নটি ছিল একদম ছেলেমানুষি একটি ব্যাপার। এ কাজ করে কোন ভাবেই অর্থ উপার্যন সম্ভব নয় আর একটি দরিদ্র পরিবারের জন্য লেখিকা হওয়ার স্বপ্ন নেহাতই আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাদের ইচ্ছা ছিল মেয়ে পড়াশুনা করে ডিগ্রী অর্জন করে ভাল চাকরি করে তাদের সহযোগীতা করবে তাই রাউলিংয়ের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভর্তি হন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা বিভাগে কিন্তু পরে অবশ্য তিনি বাবা কে না জানিয়েই ভর্তি হন ক্লাসিক্স অর্থাৎ ইংরেজীতে। এব্যাপারে তিঁনি বলেছিলেন,"আমার মনে পড়েনা বাবা-মা কে কখনো জানিয়েছি আমার এই কাণ্ডের কথা, খুব সম্ভবত আমার সমাবর্তনেই তাঁরা প্রথম আবিষ্কার করেছেন আমি এতদিন ক্লাসিকস নিয়ে পড়েছি।" যদিও পরবর্তীতে তিনি সল্প বেতনে একটি চাকরি পেয়ছিলেন তারপরও তার বাবা মা তার উপর তেমন খুশী ছিলেন না।
যখন তার বয়স ২৫ তখনই ১৯৯০ এ তার মা মারা যান এটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর অধ্যায়ের শুরু।এ সময়ই তিনি সল্প বেতনের চাকরী ছেড়ে পর্তুগালে ইংরেজীর শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৯২ এ পরিচয় হয় টেলিভিশন সাংবাদিক জর্জ অ্যারান্তিসের সঙ্গে। আর সেখান থেকেই পরিচয়-প্রনয়-বিয়ে আর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৩ এ জন্ম নেয় প্রথম কন্যাসন্তান জেসিকা মিটফোর্ড।
একই বছর সংসার ভাঙে রাউলিংয়ের। মানসিক অসুস্থতা, একমাত্র সন্তান ও বিয়ে বিচ্ছেদের দুঃখ নিয়ে ফের ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন তিনি। ফিরে এলেন, কিন্তু কোন চাকরী পেলেন না।
ভর্তি হলেন টিচার ট্রেইনার কোর্সে। সরকারী ভাতার উপর নির্ভরশীল একজন সিঙ্গেল মাদার, পকেটে কোন টাকা নেই, বাসা ভাড়াটাও ঠিক মত দিতে পারেন না, এমনকি খাবারও কিনতে পারেন না। ফলাফল যা হবার তাই হলো, মানসিক বিষন্নতায় রাউলিং আত্নহত্যার চেষ্টা করেন। তিনি এ সময়টাকে ব্যাখ্যা করেছেন,
"আমি যতদুর জানি তার মধ্যে আমিই হচ্ছি একমাত্র সর্বশ্রেষ্ঠ অসফল মানুষ।"যদিও পরবর্তীতে তিনি আত্নহত্যা করতে গিয়েও জেসিকার কথা ভেবে বেচে যান বুক বাধেন নতুন আশায় শুরু করেন নতুন করে তার মায়ের মৃত্যুর কিছু সময় আগে অর্থাৎ ১৯৯০ এর প্রথমদিকে একদিন রাউলিং ট্রেনে করে ম্যানচেষ্টার থেকে লন্ডন যাচ্ছিলেন।
হঠাৎ তার মাথায় একটা গল্পের ধারনা আসে যেখানের মূল চরিত্রটি ছিল সেই মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া বিস্ময় বালক হ্যারি। কিন্তু তারপরও রাউলিংএর জীবনের দুটি বছর অতিবাহিত হয়েছে সাথে নেই কিছুই যে সময়টাতে সে বেচে ফিরেছিল তখন তার কাছে ছিল চারটি জিনিস প্রথমটি হচ্ছে তার মেয়ে জেসিকা দ্বিতীয়টি মনে ভিতরে জিয়ে রাখা একটি স্বপ্ন ও সাহস আর ছিল একটি পুরাতন টাইপ মেশিন এবং সর্বশেষ একটি কয়েক বছরের পুরাতন ভাঙ্গাচুরা গল্প।তাই এসকল দৈনন্দিন বিশৃংখলা স্বত্ত্বেও তিনি কখনোই আস্থা হারাননি তার গল্প এবং তার গল্প বলার ক্ষমতার উপর। তাই তিনি পুনরায় লেখা শুরু করেন হ্যারি পটার সিরিজের প্রথম খণ্ড "হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফার'স স্টোন"।
তার ক্যাফেতে লেখার কারন ছিল, উনি চাইতেন ক্যাফেতে হেঁটে যাওয়ার ক্লান্তিতে তার মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুক আর তিনি একান্ত মনে লিখতে পারেন। লেখা শুরুর প্রায় পাঁচ বছর পর ১৯৯৫ এর গোড়ার দিকে তিনি হ্যারি পোটার উপন্যাস শেষ করেন সব মিলেয়ে এই সাত বছরে রাওলিং তার মায়ের মৃত্যু দেখেছেন, তার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছে, বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটেছে।
এবং চরম আর্থিক কষ্টের ভেতর দিয়ে গিয়েছেন। তারপরও তিনি তার স্বপ্নকে আগলে ধরে এতদুর এসেছেন হাল ছাড়েন নি। কিন্তু দীর্ঘ সাত বছর পর তাকে নতুন করে পড়তে হয় বিশাল সমস্যায় কেননা একে একে বারোটি প্রকাশনা সংস্থা তার পটার সিরিজের প্রথম খণ্ড "হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফার'স স্টোন"প্রকাশে অনীহা দেখিয়েছিল। যেটি হয়ত দুর্বল হৃদয়ের মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়টা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার তারপরও রাউলিং সবকিছুকে পিছনে ফেলে অনেক কষ্টে একজন এজেন্টকে খুজে পান তার নাম ছিল ব্যারি ক্যানিংহাম যিনি রাউলিংকে উপদেশ দিয়েছিলেন বই না লিখে তার বরং একটা চাকুরির চেষ্টা করা উচিত। এবং তার মাধ্যমেই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ব্লুমসবেরি তার বইটি প্রকাশের আগ্রহ দেখায়। মাত্র ১৫০০ পাউন্ড অগ্রিম অর্থ নিয়ে তিনি পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশনীর কাছে হস্তান্তর করেন। এপর ১৯৯৭ এ প্রথম সংস্করণে মাত্র এক হাজার কপি বই প্রকাশ করে সংস্থাটি।এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি জে. কে. রাউলিংকে।বইটি প্রকাশের পর ছেলেবেলার স্বপ্ন যেন বাস্তবে রূপ নেয়।
প্রকাশের বছরেই বইটি জিতে নেয় ‘নেস্লে স্মার্টিস বুক প্রাইজ’ এবং শিশু সাহিত্য বিভাগে ‘ব্রিটিশ বুক অ্যাওয়ার্ড’। এছাড়াও হ্যারি পটার সিরিজ ফিলোসফার্স স্টোন প্রকাশের পর থেকে অনেক পুরষ্কার পেয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চারটি হুইটেকার প্লাটিনাম বুক এওয়ার্ডস , তিনটি নেসলে স্মার্টিস বুক প্রাইজ , দুটি স্কটিশ আর্টস কাউন্সিল বুক এওয়ার্ডস , উদ্বোধনী হুইটব্রেড বর্ষসেরা শিশুতোষ গ্রন্থ পুরষ্কার,ডব্লিউ এইচ স্মিথ বর্ষসেরা বই ।
২০০০ সালে হ্যারি পটার এন্ড দ্য প্রজনার অব আজকাবান শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বিভাগে হিউগো পুরষ্কারের জন্য মনীত হয় কিন্তু পায়নি। তবে ২০০১ সালে হ্যারি পটার এন্ড দ্য গবলেট অব ফায়ার বইটি উক্ত পুরষ্কার ছিনিয়ে নেয়। অন্যান্য সম্মাননার মধ্যে রয়েছে কার্নেগি মেডেলের জন্য ১৯৯৭ সালে মনোনয়ন, ১৯৯৮ সালে গার্ডিয়ান চিলড্রেন’স এওয়ার্ড পুরষ্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান, বিভিন্ন স্থানে স্মরনীয় বইয়ের তালিকায় স্থান, আমেরিকান লাইব্রেরী এসোসিয়েশন, নিউ ইয়র্ক টাইমস, শিকাগো পাবলিক লাইব্রেরী ও পাবলিশার্স উইকলি প্রভৃতিতে সম্পাদকের পছন্ধ এবং প্রস্তাবিত শ্রেষ্ঠ বই তালিকায় অবস্থান করে রাউলিং এর হ্যারি পটার সিরিজের বই গুলি।
২০০৭ সালে হ্যারি পটার সিরিজের সর্বশেষ খণ্ডটি প্রকাশিত হয়। এই খণ্ডের নাম ছিল 'হ্যারি পটার অ্যান্ড ডেথলি হ্যালোস'। হ্যারিপটার সিরিজের চতুর্থ বইটি প্রকাশের প্রথম দিন তিন লাখ কপি বিক্রি হওয়ার অনন্য নজির স্থাপন করেছে ইতিমধ্যে। হ্যারি পটার সিরিজের মাধ্যমে জে. কে. রাউলিং শুধু লেখক খ্যাতিই নয় বরং প্রভাবশালী ও অর্থশালীদের তালিকায়ও স্থান করে নেন। এই সিরিজের ৭টি বই ৪০০ মিলিয়ন কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছে, যা সিরিজ বইয়ের ক্ষেত্রে অলটাইম রেকর্ড। এই সিরিজের মুভির আয়ও রেকর্ড বইয়ের পাতা নতুন করে লিখিয়েছে। জে কে রাউলিং এখন ইংল্যান্ডের অন্যতম ধনী মানুষ ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফোর্বস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তার সম্পত্তির পরিমাণ £৫৭৬ মিলিয়ন (১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কিছু বেশি) , যা তাকে বই-লিখে বড়লোক হওয়া প্রথম বিলিয়নিয়ার (আমেরিকান ডলারে) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।২০০৬ সালে ফোর্বস পত্রিকা তাকে অপরাহ উইনফ্রের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় সেরা মহিলা ধনী হিসেবে তথ্য প্রকাশ করেছে।
বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠান দরিদ্র এবং শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে। পরবর্তীতে ২০০১ সালে নিল মিখাইল মুরিকে দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ে করেন রাউলিং। এই দম্পতির একমাত্র পুত্রসন্তান ডেভিড গর্ডন রাউলিং মুরি। এক সাক্ষাৎকারে রাউলিং বলেন-
'জীবনের স্বপ্ন এবং সম্ভাবনার কথাগুলোই আমি লিখি। আমাদের পৃথিবীকে পাল্টে ফেলতে কোনো জাদুর প্রয়োজন নেই। অন্তরে আমরা সব শক্তিকেই ধারণ করি। ভালো কিছু করার কল্পনা শক্তিই শুধু আমাদের প্রয়োজন।'
এবং তিনি সেটা করে দেখিয়েছে এবং আমাদের সুপ্ত প্রতিভাগুলোকে উন্মোচনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এক বক্তৃতায় রাউলিং বলেছিলেন-
'এখানে উপস্থিত কেউ আমার মতো ব্যর্থ হয়নি জীবনে। কিন্তু জীবনের কিছু ব্যর্থতা এড়ানো সম্ভব নয়। ব্যর্থতা ছাড়া আমরা কেউ বাঁচতেও পারব না, যদি না আপনি খুব সতর্ক থাকেন, তখন সেটাকে আর বেঁচে থাকা বলে না।'
নিজের ৫০তম জন্মবার্ষিকীতে রাউলিং বলেছিলেন- 'কত দিন বাঁচব আমরা কেউ জানি না। আমার মা মারা গেছেন ৪৫ বছর বয়সে। তাই প্রতি বছরের এই দিনটিকে উদযাপন করা উচিত। আর প্রাথর্না করা উচিত, বাকি বছরগুলো যেন সুস্থ থাকা যায়।' জীবনে চলার পথে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাধা বিপত্তি আসতেই পারে আর ব্যর্থতা মানেই হেরে যাওয়া নয় ব্যর্থতাই আমাদের সফলতারদ্বার কে উন্মোচিত করে সেটি ভাল ভাবে করে দেখিয়েছেন এই ৫৫ বছর বয়সী ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক। তিনি ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে পেরেছিলেন বলেই হয়ত আজ সফলতা পেয়েছেন।নিজের সুপ্ত প্রতিভা গুলোকে বিকশিত করার মাধ্যমেই আমাদের জীবনে আসুক নতুন ছন্দ সেই সাথে কল্পরাজ্যের জে কে রাউলিং হোক সকলের এক অনুপ্রেরণার গল্প।