সমাজের প্রচলিত ধ্যান ধারণা অনুযায়ী আমাদের সমাজে বহুল আলোচিত একটি কথা প্রচলিত ছেলে সন্তানের তুলনায় মেয়ে সন্তান কম মেধাবী। এই প্রচলিত কথার ভিত্তিতেই সমাজের জেন্ডার বিভাজনের মাত্রা দিনকে দিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর বিদ্যালয় যেহেতু সমাজের প্রতিচ্ছবি সেই সাথে বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বুদ্ধি বৃত্তিক চর্চারও প্রধানতম জায়গা যার ফলে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশকৃত এই ধ্যান ধারণা গুলোর যথেষ্ট শক্তপোক্ত স্থান রয়েছে বিদ্যালয় তথা শ্রেণীকক্ষে।বিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতিকাল থেকে জেন্ডার বৈষ্যম্যের গোড়াপত্তন ঘঠলেও এর দৃশ্যমানরূপ পরিলক্ষিত হয় নবম শ্রেণীতে বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে। দেখা যায় বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির দিক থেকে মেয়েরা অনেকাংশেই পিছিয়ে থাকে ছেলেদের তুলনায়।
শুধু তাই নয় স্তর ভিত্তিক শিক্ষার পরিসংখ্যানে প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তরে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা তুলানামুলক ভাল থাকলেও ধীরে ধীরে চিত্র বদলাতে থাকে মাধ্যমিকের শেষ ভাগ থেকে এবং উচ্চ শিক্ষা স্তরে এর হার একেবারেই নিম্নগামী। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) বলছে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক (১ম-১০ম) পর্যন্ত দেশে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা গড়ে ৫২.৫১ শতাংশ কিন্তু উচ্চ শিক্ষা স্তরে এর হার ৩৬.০৭ শতাংশ।
সত্যিকার অর্থে এই আকাশ পাতাল পার্থক্যের পিছনের প্রধান কারণটিই হচ্ছে সেই প্রাচীন তথা কথিত ধারণা বা বোধগম্য করে বলতে গেলে মিথ সেটি হচ্ছে ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় বেশি মেধাবী। সমাজ বিশ্লেষক যারা রয়েছেন তারা হয়ত অনেক কারন দেখাবেন সেটি হতে পারে ১। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ২। বাল্যবিবাহ ৩। অসচেতনতা ইত্যাদি তবে এই সমস্যা গুলোর গোরার দিকে তাকালে একটি বিষয়ই বারবার দৃশ্যমান হয় তা হচ্ছে প্রাচীন তথাকথিত মিথ। পাশ্চাত্যের দেশ গুলো এটি থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছে জন্যই তাদের নারী শিক্ষা যেমন বেড়েছে তেমনি দেশ হয়েছে উন্নত। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখা তারা না পড়লেও হয়ত উপলব্ধি করেছে বহু আগেই “সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদুর চলিবে’’ এখন হয়ত সময় এসেছে এই প্রশ্নটি উত্তর খোঁজার “ কে বেশী মেধাবী ছেলে নাকি মেয়ে?’’ মেধা বা বুদ্ধিগত বিষয় গুলো পরিমাপনের ক্ষেত্রে শিক্ষা মনবিজ্ঞান হতে পারে একটি সহজ সমাধানের নাম। মনোবিজ্ঞানী বাকিংহাম বলেছেন ,”বুদ্ধি হল শিক্ষা লাভের ক্ষমতা” আবার বুদ্ধির সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কগনিটিভ স্কিল। ব্যাপারটি খুব কষ্ট সাধ্য মনে হলেও সহজ কথায় বুঝা যায় খুব সহজে কগনিটিভ শব্দটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার থেকে শব্দ গত ব্যাপারটি বুঝার ক্ষেত্রে অনেক সহায়ক হবে Cognitive শব্দটি এসেছে cognition থেকে যার অর্থ process of knowing ,perceiving (হৃদয়ঙ্গম করা) অর্থাৎ জ্ঞান অর্জনের দক্ষতা বা কোন উপলব্ধি করবার ক্ষমতাই cognitive skill.
এখন প্রশ্ন আসতে পারে এসব বুদ্ধি বা কগনিটিভ স্কিলের সাথে শ্রেণীকক্ষ কিংবা প্রাচীন ধ্যান ধারনার সাথে বস্তুগত মিলটা কোথায়? এক কথায় যদি বলি তাহলে মেয়েদের বুদ্ধি কম তার মানেই হচ্ছে তাদের কগনিটিভ স্কিল কম। বোধগম্য হল না তো? তবে চলুন চোখ বুলিয়ে আসি আমাদের বিদ্যালয়গুলোর সদ্য জে.এস.সি পরীক্ষায় পাশ করে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হবার সময়টিতে যে খানে নতুন এক পরীক্ষার নাম বিভাগ নির্বাচন সেক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজের সহজ সমাধান ছেলেটা বিজ্ঞান আর মেয়েটাকে ভর্তি করাবো মানবিকে।যদিও ২০০৯-১০ সাল থেকে এর কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে ।তবে এর কারন উদঘাটনে বেড়িয়ে আসে একটি কথাই তা হচ্ছে ছেলেরা গণিতে ভাল আর মেয়েরা সাহ্যিতে। তবে বিজ্ঞান কি বলে? আসলেই কি এটি সত্য নাকি ধারণা। তবে এ কথাটি সত্যি যে সৃষ্টিগত কারনেই নারী ও পুরুষের মাঝে সুনির্দিষ্ট কিছু পার্থক্য বিদ্যমান কিন্তু জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে আদও কি কোন পার্থক্য আছে? আপনার মত জানতে চাই আমিও চলুন জেনে নেই বিজ্ঞানের ভাষায়। এই ধারনাটি প্রমানের জন্য করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ১৯৯০ সালের দিকে, উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী জ্যানেট শিবলি হাইড, (পিএইচডি) এবং তার সহকর্মীরা ১০০ টির মত গানিতিক সমস্যা সমাধানের দক্ষতার তথ্য সংগ্রহ করে একটি গ্রাউন্ডব্রেকিং মেটা-বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছিলেন । এর আগে ১৯৬৭ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে তিন মিলিয়নেরও বেশি অংশগ্রহণকারীদের সংগৃহীত তথ্য সংশ্লেষ করে গবেষকরা গণিতের সমস্যা সমাধানের দক্ষতার ক্ষেত্রে ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে বৃহত্তর কোন সামগ্রিক পার্থক্য খুঁজে পাননি । গবেষকরা বলছেন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক(১ম-৭ম) বিদ্যালয়ে গণিতে মেয়েরা কিছুটা ভাল দক্ষতা দেখায় । তবে উচ্চ বিদ্যালয়ে ছেলেরা সমস্যা সমাধানে কিছুটা তীক্ষ্ণতা দেখায়,এছাড়াও তারা বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতেও এই দক্ষতা বজায় রাখে। তবে ছেলেরা এবং মেয়েরা গণিতের ধারণাগুলি সমানভাবে বুঝতে পারে এবং জেন্ডার পার্থক্যগুলি বছরের পর বছরগুলিতে সংকীর্ণ হয়ে প্রায় একটি স্থির অবস্থানে পৌঁছেছে । ২০০৫ সালে এর একটি প্রতিবেদনে হাইড যৌনতাগত পার্থক্য সম্পর্কে ৪৬ টি বিভিন্ন মেটা-বিশ্লেষণ পর্যালোচনা করেছেন, এটি কেবল জ্ঞান নয়, যোগাযোগের শৈলী, সামাজিক এবং ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনশীল, মোটর আচরণ এবং নৈতিক যুক্তি বিষয়ক তবে এসকল গবেষণায় জেন্ডারগত পার্থক্য ছিল খুবিই কম ।
এছাড়াও ২০০৫ সালে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী এলিজাবেথ স্পেল্ক পিএইচডি এবং তার সহকর্মীরা ১১১ টি গবেষণা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে গণিত এবং বিজ্ঞানের দক্ষতার ক্ষেত্রে লিঙ্গগত পার্থক্যগুলিতে cognitive skill এর জিনগত ভিত্তি রয়েছে যা শৈশবে শিশুদের মধ্যে উদ্ভূত হয় । তবুও, সমীক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে যে পুরুষ এবং মহিলাদের গণিত এবং বিজ্ঞানের জন্য সমান দক্ষতা রাখেন । আসলে, ছেলে এবং মেয়ে শিশুদের সমানভাবে পাশাপাশি যে কাজগুলো করতে গণিত দক্ষতার মুটামুটি ০৩ মাসের বুদ্ধিগত পার্থক্য রয়েছে । এই গবেষণা গুলোর ফলাফল বলছে বুদ্ধি বা জ্ঞান গত পার্থক্যের ক্ষেত্রে জেন্ডার আসলে তেমন গুরুত্ব পূর্ণ নিয়ামক নয় তার পরেও এ জাতীয় প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, লিঙ্গগত পার্থক্যের প্রশ্নগুলি বা মিথ গুলো সমাজে বজায় রয়েছে, শুধু তাই নয় এর একটি সামগ্রিক প্রভাব সমাজের রয়েছে এর কারণ হিসেবে ধরা হয় বিজ্ঞান এবং গণিত বিষয়ক যেসকল ক্যারিয়ার রয়েছে তাতে নারীদের চেয়ে পুরুষের অংশগ্রহণ তুলানামুলক বেশি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ -এ ডায়ান হলপার্ন, পিএইচডি, এবং হাইড সহ সহকর্মীরা অসমতা সংক্রান্ত একটি ঐক্যমত্যে পৌঁছেন এবং এর একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। তাঁদের এই যুগল গবেষণায় বলা হয়েছে যে মৌখিক দক্ষতায় পুরুষদের তুলনায় নারীরা কিছুটা বেশি দক্ষতা দেখান, অন্যদিকে ভিজুস্পেসিয়াল দক্ষতার ক্ষেত্রে পুরুষদের মধ্যে নারীদের থেকে কিছুটা বেশী দক্ষতা রয়েছে।যাইহোক, জীববৈজ্ঞানিক পার্থক্যের ব্যাখ্যাটি কেবল গবেষণার একটি ছোট্ট অংশ মাত্র। তবে গবেষকরা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে পূর্ব অভিজ্ঞতা, বংশগতি ,শিক্ষানীতি ও সংস্কৃতি দৃঢ়ভাবে গণিত এবং বিজ্ঞানে সাফল্য তথা জেন্ডার ভিত্তিক পার্থক্যকে প্রভাবিত করে। এর পরও বসে থাকেনি বিজ্ঞানিদল আবারও হাইড ২০০৮ ও ২০০৯ সালে বেশ কিছু ১১ গ্রেডের শিক্ষার্থীদের মাঝে গবেষণা চালান তাতে তিনি বছরের পরিবর্তনের সাথে সাথে জেন্ডার গত পার্থক্য প্রায় শূন্যের কাছাকাছি পৌঁছায় বলে দাবি করেন। এমনকি একই সালে ২০০৯-এ, জেনেট মের্টজ, পিএইচডি জানিয়েছেন যে মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা যখন গণিতে সর্বোচ্চ স্তরে স্কোর করে, সেই লিঙ্গ ব্যবধান সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়ে সমান হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে, তারা জানিয়েছে যে বৃহত্তর লিঙ্গ সমতাভিত্তিক দেশগুলিতে এই ব্যবধানটি প্রথম দিক থেকেই অনেকাংশেই কম, তারা দাবি করেন গণিতের জ্ঞান অর্জনে লিঙ্গগত পার্থক্য মূলত সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশগত কারণগুলির কারণেই ঘটে থাকে।
মর্মার্থঃ গবেষণাটি প্রমান করে যে পুরুষ এবং স্ত্রীলোকদের মধ্যে জ্ঞানীয় দক্ষতা cognitive skill বা জেন্ডারগত পার্থক্য সম্ভবত সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কারণের ফলাফল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গণিতে মেয়ে এবং ছেলেদের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, তার কারন হিসেবে গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে সামাজিক প্রেক্ষাপট। যা মেয়েদের পিছিয়ে থাকার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে সেই আদিকাল হতেই।আরও একজন ক্যারিয়ার ও শিক্ষা বিশ্লেষক স্পেলক মনে করেন যে, ক্যারিয়ারের নির্বাচনের ক্ষেত্রে পার্থক্য উচ্চতর বিষয় ভিত্তিক দক্ষতার নয় বরং সাংস্কৃতির কারণের এবং এর সূচনা হয় বিদ্যালয় গুলো থেকেই। তবে সব থেকে বড় আরেকটি নিয়ামক রয়েছে সেটি হচ্ছে Anxiety বা উদ্বেগ যা বায়োলজিক্যালই মেয়েদের গানিতিক দক্ষতার উপর প্রভাব বিস্তার করে।তবে গবেষকরা মনে করেন এই Anxiety নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে মেয়েরাও গাণিতিক ভাবে ছেলেদের সমান উচ্চতর সমস্যাগুলো সমাধান করতে সক্ষম হবে যা শুধু মাত্র সাংস্কৃতিক বাতাবরন পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই অর্জন করা সম্ভব।
ব্যবহারিক প্রয়োগঃ যদিও পুরুষ এবং মহিলা সত্যিকার অর্থে বৌদ্ধিক হিসাবে তুলনামূলক ভাবে সমান। তবে বাস্তবিক ক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ ,বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্প কল কারখানা এবং সাধারণভাবে কর্মক্ষেত্রে বুদ্ধি বৃত্তিক মূল্যায়ন পরিবর্তিত হতে পারে। এছাড়াও ১৯৯০ সালের গবেষণার বিভিন্ন সমালচনাও রয়েছে। তবে প্রকৌশল বিদ্যা ও পদার্থবিদ্যার জটিল জটিল গানিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন “সমস্যা সমাধানের দক্ষতা’’ অর্জন করা । যেটি হয়ত শিশুদের প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত গানিতিক সমস্যার সাথে মিল রেখে প্রয়োজনীয় সমস্যা সমাধানের দক্ষতা শেখানো উচিত। পরবর্তীতে যাতে ক্যারিয়ার গঠনে Aptitude Test এ তা সকলকেই এগিয়ে রাখে। তবে সামগ্রিক ফলাফলে প্রাপ্ত স্কোরগুলি ভর্তি এবং বৃত্তির সিদ্ধান্তগুলিতে ব্যবহৃত হওয়া উচিত শুধু মাত্র একক বিষয় ভিত্তিক যেন সেটি না হয়। তাই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত এই ত্রুটিপূর্ণ এই মিথ থেকে আমাদের সকলকেই বেরিয়ে আসতে হবে যথাযথ সুযোগ পেলে আপনার মেয়েটিও গানিতিক ভাবে সমান দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সত্যিকার অর্থে এই আকাশ পাতাল পার্থক্যের পিছনের প্রধান কারণটিই হচ্ছে সেই প্রাচীন তথা কথিত ধারণা বা বোধগম্য করে বলতে গেলে মিথ সেটি হচ্ছে ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় বেশি মেধাবী। সমাজ বিশ্লেষক যারা রয়েছেন তারা হয়ত অনেক কারন দেখাবেন সেটি হতে পারে ১। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ২। বাল্যবিবাহ ৩। অসচেতনতা ইত্যাদি তবে এই সমস্যা গুলোর গোরার দিকে তাকালে একটি বিষয়ই বারবার দৃশ্যমান হয় তা হচ্ছে প্রাচীন তথাকথিত মিথ। পাশ্চাত্যের দেশ গুলো এটি থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছে জন্যই তাদের নারী শিক্ষা যেমন বেড়েছে তেমনি দেশ হয়েছে উন্নত। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখা তারা না পড়লেও হয়ত উপলব্ধি করেছে বহু আগেই “সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদুর চলিবে’’ এখন হয়ত সময় এসেছে এই প্রশ্নটি উত্তর খোঁজার “ কে বেশী মেধাবী ছেলে নাকি মেয়ে?’’ মেধা বা বুদ্ধিগত বিষয় গুলো পরিমাপনের ক্ষেত্রে শিক্ষা মনবিজ্ঞান হতে পারে একটি সহজ সমাধানের নাম। মনোবিজ্ঞানী বাকিংহাম বলেছেন ,”বুদ্ধি হল শিক্ষা লাভের ক্ষমতা” আবার বুদ্ধির সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কগনিটিভ স্কিল। ব্যাপারটি খুব কষ্ট সাধ্য মনে হলেও সহজ কথায় বুঝা যায় খুব সহজে কগনিটিভ শব্দটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার থেকে শব্দ গত ব্যাপারটি বুঝার ক্ষেত্রে অনেক সহায়ক হবে Cognitive শব্দটি এসেছে cognition থেকে যার অর্থ process of knowing ,perceiving (হৃদয়ঙ্গম করা) অর্থাৎ জ্ঞান অর্জনের দক্ষতা বা কোন উপলব্ধি করবার ক্ষমতাই cognitive skill.
এখন প্রশ্ন আসতে পারে এসব বুদ্ধি বা কগনিটিভ স্কিলের সাথে শ্রেণীকক্ষ কিংবা প্রাচীন ধ্যান ধারনার সাথে বস্তুগত মিলটা কোথায়? এক কথায় যদি বলি তাহলে মেয়েদের বুদ্ধি কম তার মানেই হচ্ছে তাদের কগনিটিভ স্কিল কম। বোধগম্য হল না তো? তবে চলুন চোখ বুলিয়ে আসি আমাদের বিদ্যালয়গুলোর সদ্য জে.এস.সি পরীক্ষায় পাশ করে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হবার সময়টিতে যে খানে নতুন এক পরীক্ষার নাম বিভাগ নির্বাচন সেক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজের সহজ সমাধান ছেলেটা বিজ্ঞান আর মেয়েটাকে ভর্তি করাবো মানবিকে।যদিও ২০০৯-১০ সাল থেকে এর কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে ।তবে এর কারন উদঘাটনে বেড়িয়ে আসে একটি কথাই তা হচ্ছে ছেলেরা গণিতে ভাল আর মেয়েরা সাহ্যিতে। তবে বিজ্ঞান কি বলে? আসলেই কি এটি সত্য নাকি ধারণা। তবে এ কথাটি সত্যি যে সৃষ্টিগত কারনেই নারী ও পুরুষের মাঝে সুনির্দিষ্ট কিছু পার্থক্য বিদ্যমান কিন্তু জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে আদও কি কোন পার্থক্য আছে? আপনার মত জানতে চাই আমিও চলুন জেনে নেই বিজ্ঞানের ভাষায়। এই ধারনাটি প্রমানের জন্য করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ১৯৯০ সালের দিকে, উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী জ্যানেট শিবলি হাইড, (পিএইচডি) এবং তার সহকর্মীরা ১০০ টির মত গানিতিক সমস্যা সমাধানের দক্ষতার তথ্য সংগ্রহ করে একটি গ্রাউন্ডব্রেকিং মেটা-বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছিলেন । এর আগে ১৯৬৭ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে তিন মিলিয়নেরও বেশি অংশগ্রহণকারীদের সংগৃহীত তথ্য সংশ্লেষ করে গবেষকরা গণিতের সমস্যা সমাধানের দক্ষতার ক্ষেত্রে ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে বৃহত্তর কোন সামগ্রিক পার্থক্য খুঁজে পাননি । গবেষকরা বলছেন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক(১ম-৭ম) বিদ্যালয়ে গণিতে মেয়েরা কিছুটা ভাল দক্ষতা দেখায় । তবে উচ্চ বিদ্যালয়ে ছেলেরা সমস্যা সমাধানে কিছুটা তীক্ষ্ণতা দেখায়,এছাড়াও তারা বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতেও এই দক্ষতা বজায় রাখে। তবে ছেলেরা এবং মেয়েরা গণিতের ধারণাগুলি সমানভাবে বুঝতে পারে এবং জেন্ডার পার্থক্যগুলি বছরের পর বছরগুলিতে সংকীর্ণ হয়ে প্রায় একটি স্থির অবস্থানে পৌঁছেছে । ২০০৫ সালে এর একটি প্রতিবেদনে হাইড যৌনতাগত পার্থক্য সম্পর্কে ৪৬ টি বিভিন্ন মেটা-বিশ্লেষণ পর্যালোচনা করেছেন, এটি কেবল জ্ঞান নয়, যোগাযোগের শৈলী, সামাজিক এবং ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনশীল, মোটর আচরণ এবং নৈতিক যুক্তি বিষয়ক তবে এসকল গবেষণায় জেন্ডারগত পার্থক্য ছিল খুবিই কম ।
এছাড়াও ২০০৫ সালে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী এলিজাবেথ স্পেল্ক পিএইচডি এবং তার সহকর্মীরা ১১১ টি গবেষণা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে গণিত এবং বিজ্ঞানের দক্ষতার ক্ষেত্রে লিঙ্গগত পার্থক্যগুলিতে cognitive skill এর জিনগত ভিত্তি রয়েছে যা শৈশবে শিশুদের মধ্যে উদ্ভূত হয় । তবুও, সমীক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে যে পুরুষ এবং মহিলাদের গণিত এবং বিজ্ঞানের জন্য সমান দক্ষতা রাখেন । আসলে, ছেলে এবং মেয়ে শিশুদের সমানভাবে পাশাপাশি যে কাজগুলো করতে গণিত দক্ষতার মুটামুটি ০৩ মাসের বুদ্ধিগত পার্থক্য রয়েছে । এই গবেষণা গুলোর ফলাফল বলছে বুদ্ধি বা জ্ঞান গত পার্থক্যের ক্ষেত্রে জেন্ডার আসলে তেমন গুরুত্ব পূর্ণ নিয়ামক নয় তার পরেও এ জাতীয় প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, লিঙ্গগত পার্থক্যের প্রশ্নগুলি বা মিথ গুলো সমাজে বজায় রয়েছে, শুধু তাই নয় এর একটি সামগ্রিক প্রভাব সমাজের রয়েছে এর কারণ হিসেবে ধরা হয় বিজ্ঞান এবং গণিত বিষয়ক যেসকল ক্যারিয়ার রয়েছে তাতে নারীদের চেয়ে পুরুষের অংশগ্রহণ তুলানামুলক বেশি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ -এ ডায়ান হলপার্ন, পিএইচডি, এবং হাইড সহ সহকর্মীরা অসমতা সংক্রান্ত একটি ঐক্যমত্যে পৌঁছেন এবং এর একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। তাঁদের এই যুগল গবেষণায় বলা হয়েছে যে মৌখিক দক্ষতায় পুরুষদের তুলনায় নারীরা কিছুটা বেশি দক্ষতা দেখান, অন্যদিকে ভিজুস্পেসিয়াল দক্ষতার ক্ষেত্রে পুরুষদের মধ্যে নারীদের থেকে কিছুটা বেশী দক্ষতা রয়েছে।যাইহোক, জীববৈজ্ঞানিক পার্থক্যের ব্যাখ্যাটি কেবল গবেষণার একটি ছোট্ট অংশ মাত্র। তবে গবেষকরা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে পূর্ব অভিজ্ঞতা, বংশগতি ,শিক্ষানীতি ও সংস্কৃতি দৃঢ়ভাবে গণিত এবং বিজ্ঞানে সাফল্য তথা জেন্ডার ভিত্তিক পার্থক্যকে প্রভাবিত করে। এর পরও বসে থাকেনি বিজ্ঞানিদল আবারও হাইড ২০০৮ ও ২০০৯ সালে বেশ কিছু ১১ গ্রেডের শিক্ষার্থীদের মাঝে গবেষণা চালান তাতে তিনি বছরের পরিবর্তনের সাথে সাথে জেন্ডার গত পার্থক্য প্রায় শূন্যের কাছাকাছি পৌঁছায় বলে দাবি করেন। এমনকি একই সালে ২০০৯-এ, জেনেট মের্টজ, পিএইচডি জানিয়েছেন যে মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা যখন গণিতে সর্বোচ্চ স্তরে স্কোর করে, সেই লিঙ্গ ব্যবধান সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়ে সমান হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে, তারা জানিয়েছে যে বৃহত্তর লিঙ্গ সমতাভিত্তিক দেশগুলিতে এই ব্যবধানটি প্রথম দিক থেকেই অনেকাংশেই কম, তারা দাবি করেন গণিতের জ্ঞান অর্জনে লিঙ্গগত পার্থক্য মূলত সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশগত কারণগুলির কারণেই ঘটে থাকে।
মর্মার্থঃ গবেষণাটি প্রমান করে যে পুরুষ এবং স্ত্রীলোকদের মধ্যে জ্ঞানীয় দক্ষতা cognitive skill বা জেন্ডারগত পার্থক্য সম্ভবত সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কারণের ফলাফল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গণিতে মেয়ে এবং ছেলেদের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, তার কারন হিসেবে গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে সামাজিক প্রেক্ষাপট। যা মেয়েদের পিছিয়ে থাকার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে সেই আদিকাল হতেই।আরও একজন ক্যারিয়ার ও শিক্ষা বিশ্লেষক স্পেলক মনে করেন যে, ক্যারিয়ারের নির্বাচনের ক্ষেত্রে পার্থক্য উচ্চতর বিষয় ভিত্তিক দক্ষতার নয় বরং সাংস্কৃতির কারণের এবং এর সূচনা হয় বিদ্যালয় গুলো থেকেই। তবে সব থেকে বড় আরেকটি নিয়ামক রয়েছে সেটি হচ্ছে Anxiety বা উদ্বেগ যা বায়োলজিক্যালই মেয়েদের গানিতিক দক্ষতার উপর প্রভাব বিস্তার করে।তবে গবেষকরা মনে করেন এই Anxiety নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে মেয়েরাও গাণিতিক ভাবে ছেলেদের সমান উচ্চতর সমস্যাগুলো সমাধান করতে সক্ষম হবে যা শুধু মাত্র সাংস্কৃতিক বাতাবরন পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই অর্জন করা সম্ভব।
ব্যবহারিক প্রয়োগঃ যদিও পুরুষ এবং মহিলা সত্যিকার অর্থে বৌদ্ধিক হিসাবে তুলনামূলক ভাবে সমান। তবে বাস্তবিক ক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ ,বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্প কল কারখানা এবং সাধারণভাবে কর্মক্ষেত্রে বুদ্ধি বৃত্তিক মূল্যায়ন পরিবর্তিত হতে পারে। এছাড়াও ১৯৯০ সালের গবেষণার বিভিন্ন সমালচনাও রয়েছে। তবে প্রকৌশল বিদ্যা ও পদার্থবিদ্যার জটিল জটিল গানিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন “সমস্যা সমাধানের দক্ষতা’’ অর্জন করা । যেটি হয়ত শিশুদের প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত গানিতিক সমস্যার সাথে মিল রেখে প্রয়োজনীয় সমস্যা সমাধানের দক্ষতা শেখানো উচিত। পরবর্তীতে যাতে ক্যারিয়ার গঠনে Aptitude Test এ তা সকলকেই এগিয়ে রাখে। তবে সামগ্রিক ফলাফলে প্রাপ্ত স্কোরগুলি ভর্তি এবং বৃত্তির সিদ্ধান্তগুলিতে ব্যবহৃত হওয়া উচিত শুধু মাত্র একক বিষয় ভিত্তিক যেন সেটি না হয়। তাই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত এই ত্রুটিপূর্ণ এই মিথ থেকে আমাদের সকলকেই বেরিয়ে আসতে হবে যথাযথ সুযোগ পেলে আপনার মেয়েটিও গানিতিক ভাবে সমান দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।